বুলবুল আহম্মেদ জয়
মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা চিরকালই মানসিকভাবে পরাধীন। খুব ছোটবেলা থেকেই বাপ-মা-জ্ঞাতি-গোষ্ঠী তাদের মাথায় খুব ভালোমত ঢুকিয়ে দেয় যে “বাপরে/মাগো , চব্বিশটা ঘন্টা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত মুখে রক্ত তুলে শুধু খাটছি তোকে লেখাপড়া করাব বলে। তুই-ই আমাদের একমাত্র আশা, ভরসা। তোর মুখের দিকে চেয়ে সব কষ্ট সহ্য করছি সোনা । আর কোন দিকে মন দিস না। আমাদের আর কোন ক্ষমতাই নাইরে বাপধন, একটা বিপদে পড়ে গেলে কেউ বাঁচাতে আসবে না। তুই আমাদের একমাত্র স্বপ্ন । "
ক্লাস থ্রিতে পড়া মেয়েটা সেই থেকে বার্বি হাতে দাঁড়ানো প্রতিবেশী আন্টির মেয়েকে দেখে শুধু , মুখ ফুটে কোনদিন বাপমা কে বলেনা ঐ পুতুলটা তারও কত ভালো লাগে। সেও কত খুশি হত ঐ সব রঙ্গীণ প্রজাপতি-ক্লিপ দিয়ে চুল বাঁধতে পেলে। দক্ষ ক্যাশিয়ারের মত বাচ্চাগুলো তখন থেকেই সুন্দর কিছু দেখলেই দামের হিসেব করে আর ভাবে, থাক, আমার এসব দেখতে হবেনা। আমার আব্বু-আম্মু দিনরাত খাটছে, আমি কোন হিসেবে এইসব চাইব।
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা শিশুকাল থেকেই বয়স্ক, দায়িত্ববোধসম্পন্ন। সপ্তম শ্রেনীর বালক কখনো স্কুলের পিকনিকে যেতে চায়না, বাড়তি ফী দিতে হবে বলে। তার মাথায় ভাসতে থাকে মায়ের ছবি, যে মা সব সময় বাবার ছেড়া শার্ট বারবার সেলাই করে দেয় । টিনটিনের ছবি আঁকা লাল রঙ এর টিশার্ট পরে বন্ধু যখন বিকেলবেলা ফুটবল খেলতে আসে, লোভীর মত সেই টিশার্টের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার আর আঁশ মেটেনা।
চতুর্থ শ্রেনীর আট বছরের মেয়েটা টিভিতে কেবলই নাচের অনুষ্ঠান খোঁজে আর একাএকা নূপুর পায়ে নাচে। অন্যদের সামনে লজ্জা পায়, বাসায় তো বাড়তি খালি জায়গাও নাই যে লুকিয়ে প্রাক্টিস করবে। একদিন মায়ের চোখে পড়ে। মা সন্ধ্যাবেলা অফিস ফেরতা বাবাকে চা আর মুড়িমাখানো খেতে দিয়ে নরম সুরে বলতে থাকে, আমাদের রুনকির না খুব নাচ ভালো লাগে।দাও না মেয়েটাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পরে এইসব বাড়তি খরচের কথা বাবার ভাল লাগেনা। এক নিঃশ্বাসে চাটুকু গিলে নিয়ে বলেন, “ কি হবে ঐসব নাচ-ফাচ করে? মেলা টাকার ব্যাপার, নাচের টিচার, নানা রকম ড্রেস, শাড়ি, চুড়ী ইত্যাদি ফ্যাচাং—আমরা কিভাবে পারব ঐসব বলো ? বাদ দাও, রুনকিকে জ্যামিতিতে মন দিতে বল। কইরে, মা, তোর অঙ্ক বইটা নিয়ে এদিকে আয়তো দেখি। "
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ের জীবনে বাড়তি কোন সুখ-সুবিধা-আগ্রহ থাকা পাপ। মেয়েটার খুব ইচ্ছে করে, ছবি তুলতে, সে যেই চোখে পৃথিবীর সৌন্দর্যগুলো দেখে তা অন্যদের দেখতে দিতে কিন্তু একটা ক্যামেরা কেনার কথা বলার জন্য বছরের পর বছর সাহস সঞ্চয় করতে হয় তার । হ্যা, তারাও মোবাইল ফোন, ক্যামেরা , ল্যাপটপ এইসব ব্যবহার করে বটে , যখন প্রয়োজনটা একদম ভয়াবহ চূড়ান্ত হয়ে যায় তখন। যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেয়ে দেয়াল দিয়ে পিঠ প্রায় বের হয়ে যায় তখন। বাপের হাজার-হাজার কর্মঘন্টার ফলাফলে এসব কিনতে হয় বলে এগুলোর প্রতি তাদের মমতা থাকে অসীম, জানে এটা হারালে / নষ্ট হলে কী ভীষণ কষ্ট হবে বাবা-মায়ের আরেকটা কিনে দিতে। প্রাণ দিয়ে যত্ন করে যন্ত্রগুলোর তবুও একদিন ভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ছেলেটার মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়ে যায়। অপরাধীর চেহারা নিয়ে বাপ-মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। মনটা এত ছোট হয়ে যায় ! এত ছোট হয়ে যায়! জীবনে আর কখনো কোন দামী ফোন ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
এত কষ্ট তাদের, এত সীমাবদ্ধতা, কেউ নেই এই এত্ত বড় দুনিয়ায় তাদের, তার উপরেই সব ভরসা বাপমায়ের-- এই কষ্টের দিন সে দূর করবে, পরিবারের মানুষদের চাওয়াপাওয়া পূরণের জন্য রক্ত দিয়ে চেষ্টা করবে। এমন আত্মপ্রতিজ্ঞা থেকেই লেখাপড়া করতে থাকে তারা, দিনরাত খেটে খেটে ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করে। এস এস সি, ইন্টারে এত্ত ভালো রেজাল্ট করার পরেও যখন কোথাও চান্স হয়না মেধাবী ছেলেটার, কিভাবে কি করবে ভেবে পায়না সে, ছোট্ট হৃদয়টা তার এত চাপ নিতে পারেনা। যখন দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লেখাপড়া করার পরেও গণহারে ফাঁস হয় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন, কিচ্ছু করার থাকেনা রাত জেগে পড়তে পড়তে চোখের কোণে কালি ফেলা মেয়েটার।অন্য কাউকে না, নিজেদেরই দোষ দেয় তারা। নিশ্চয় আরো বেশি পরিশ্রম করা উচিত ছিল। বাবা মা বলতে থাকে, “মানলাম , প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। কিন্তু একজনও কি ছিলনা যে অনেস্টলি চান্স পেয়েছে? সেই একজনই তোমার হতে হবে মা। সেই একজনই তুমি হও, এছাড়া আমাদের উপায় নেই মা, আমাদের কিচ্ছু নেই।“
ছোটবেলা থেকে এই নেই-নেই-নেই শুনতে শুনতে তাদের আত্মবিশ্বাস থাকে শূণ্যের কোঠায়। ভয়ে কারো সাথে বিবাদে জড়ায় না, নিজের স্বত্তাকেই উপলব্ধি করতে পারেনা তারা। সেও যে দেখতে ফুটফুটে সুন্দর, দারুন সুন্দর করে কথা বলে, কী অসাধারণ ভাবে চিন্তা করে, তাকায় —এসব কখনো জানা থাকেনা তাদের। যারা তাদের জীবনে এসব প্রথমে জানাতে আসে তাদের প্রেমে পড়ে যায় তারা। কিন্তু কখনো ভাবতে পারেনা এও সফল হতে পারে। তাদের যে আর কোন কিছুতে মন দেয়া পাপ। তাদের জীবনের উদ্দেশ্য একটাই, মা-বাবার স্বপ্ন সফল করা। সেইজন্য মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের সহজে প্রেম হয়না, যদিবা হয়, সেই প্রেম সহজে ভাঙ্গেনা।
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা তাই খুব অবাক হয়, যখন দেখে তাদেরই কোন সহপাঠী স্রেফ চুলের রঙ চেইঞ্জ করতে খরচ করে ফেলল এক কাঁড়ি টাকা । কিংবা নিত্য নতুন মডেলের দামী সব ফোন ব্যবহার করছে তারই কোন বন্ধু। ছুটি কাটাতে জার্মানি-ফ্রান্স ঘুরতে যায় তাদের কোন বান্ধবী। তাদেরও ইচ্ছে হয়, সারা পৃথিবী ঘুরে দেখবে, জুল ভার্নের গল্পগুলোতে যেসব জায়গার বর্ননা আছে সেসব জায়গায় যাবে কিন্তু তারা তো তবু ইউনিভার্সিটির শিক্ষা সফরের কল্যাণে অন্তত কক্সবাজার-বান্দরবান-রাঙ্গামাটি গেছে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলা তাদের বাবা-মায়েরা কখনো সেসবও দেখেনি। ছেলে-মেয়ের মুখে গল্প শুনেই পরিতৃপ্তির হাসি মুখে এনে ঘুমাতে যান তারা।
এইভাবেই ধুঁকেধুঁকে লেখাপড়া শেষে দিনের পর দিন চাকরির খোঁজে হা-পিত্যেশ করে তারা। নিজেদের অপরাধী ভাবতে থাকে, কেন এখনো জীবিকার কোন ব্যবস্থা করতে পারছে না, এই অপরাধে কুঁকড়ে থাকে, কোথাও বেড়াতে যায়না, কারো সাথে দেখা করেনা। কোন রঙ তাদের মন রঙ্গীন করেনা। তাদের কোন ঈদ,আনন্দ, গেট টুগেদার নেই। লজ্জায় কোন আত্মীয় বা বন্ধুর সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে চায়না। উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে থাকে একটা চাকরির জন্য, সেটা না জোগাড় হওয়া পর্যন্ত পারলে তারা যেন নিঃশ্বাস নেয়াটাও বন্ধ রাখত। হতাশার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যদিবা একদিন চাকরি পায় , সাগর সমান পারিবারিক দায়িত্বগুলো জ্বলোচ্ছাসের গতিতে ছুটে আসে তাদের দিকে , সেগুলো সামলাতে সামলাতে ঠিক তাদের বাবামায়ের মত করে বুড়ো হতে থাকে তারা।
No comments:
Post a Comment