• Breaking News

    Unordered List

    Saturday, February 25, 2017

    আমার মন মজাইয়ারে দিল মজাইয়া মুরশিদ নিজের দেশে ...

    বুলবুুল আহম্মেদ জয়

    ভাটি বাংলার প্রত্যন্ত দিরাই উপজেলার ধলগ্রামে শাহ আবদুল করিমের জন্ম। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর  তিনি জগতের মায়া ত্যাগ করে বিদায় নেন চিরতরে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। সে হিসেবে  বলা যায়, তিনি দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম মরমি এই সাধকের বাড়ি দেখার, তার গ্রামটি ঘুরে বেড়ানোর। সুযোগ এবং সময় পেয়ে যাওয়ায় রওনা হলাম। হাওর এলাকায় কথায় বলে, শীতে পাও, বর্ষায় নাও। আমরা যেহেতু বর্ষায় গিয়েছিলাম সেহেতু নৌকাই ছিল আমাদের ভরসা। শুনলাম শুষ্ক মৌসুমে এলাকায় ভটভটি বা নসিমন চলে। সুতরাং এখন আর হেঁটে যেতে হয় না।
    কুমিল্ল থেকে রওনা দিয়ে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা সদর থেকে দুই ঘণ্টার নৌ-পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম কালনী নদীর পাড়ে তার জন্মস্থান ধলগ্রামে। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথের প্রান্তে প্রায় ৫০ মিটার বাঁশের সাঁকো; মাত্র একটি করে বাঁশ, তার খানিক উঁচুতে ডানে বায়ে একটি করে বাঁশের রেলিং। ও-মাথায় সাঁকো থেকে নামলেই আবদুল করিমের বাড়ি।

    কালনীর সতেজ ধারা আর হাওরের নিলুয়া বাতাস শাহ আবদুল করিমকে বাউল বানিয়েছিল। আজ তিনি নেই।

    কিন্তু তার গান রয়ে গেছে চিরকালের জন্য। বাড়ির উঠোনে প্রিয়তমা সরলা খাতুনের পাশেই তার কবর। পাঠককে জানিয়ে রাখি সরলা খাতুনও সাধক ছিলেন। 
    ‘সরল তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা, সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা’ এক কালের ‘মনজান বিবি’ বাউল স্বামীরচিত এমন গীতের মধ্য দিয়ে হয়ে যান ‘সরলা’। আবদুল করিমের সাধক হয়ে ওঠার পেছনে তার অবদান ও অনুপ্রেরণা ছিল সবচেয়ে বেশি। 


    ২০০১ সালে একুশে পদক প্রাপ্তির পরই মূলত শাহ আবদুল করিম প্রচারে আসেন। যদিও তখন তিনি অনেকটাই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঠিকমতো চলতে-ফিরতে, বলতে পারতেন না। তার নাম দেশের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরার পর শেষ জীবনে এসেও তিনি অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। তার ছেলে শাহ্ নূর জালাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন, তার বাবা যদি আরো আগে জীবনের সঠিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রচার পেত তাহলে শ্রোতা এবং তিনি-দুজনেই লাভবান হতেন। তিনি হয়তো আরো বেশি আমাদের দিতে পারতেন। 

    কিন্তু এটাও মানতে হবে জীবনের পথে চলতে গিয়ে তাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। সমাজ তাকে একাধিকবার বিতাড়িত করেছে, আবার ফিরিয়েও নিয়েছে। রাতব্যাপী ওয়াজ মাহফিলের নামে গালিগালাজ করে তাকে কাফের, মুর্তাদ আখ্যা দেয়া হয়েছে। এমনকি ঈদের নামাযের খুতবাতেও তা বাদ যায়নি। শুধু তাই নয়, তার এক শিষ্যের মৃত্যু হলে গ্রামের মওলানা প্রথমে জানাজা পড়াতে রাজি হননি। অনেক অনুনয়ের পর তিনি আবদুল করিমকে শর্ত দিয়ে বলেছিলেন, তুমি যদি তওবা করে এই সমস্ত গান বাজনা ছেড়ে দাও তাহলেই কেবল জানাজা পড়ানো যেতে পারে। 
    আবদুল করিম সেই শর্ত প্রত্যাখান করেছিলেন। অথচ এই সমাজই আজ তাকে নিয়ে গর্ব করে। গ্রামের লোকজন তো বটেই আশপাশের দশ গ্রামের লোকজন গর্ব করে বলে, আবদুল করিম তাদের এলাকার সন্তান।


    তার গান গেয়ে আজ অনেকেই বড় শিল্পী হয়েছেন। অথচ জীবদ্দশায় এদের কেউই তার খোঁজ নেয়া তো দূরের কথা কৃতজ্ঞতাটুকুও প্রকাশ করেননি। বহুজাতিক টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে ব্যবসা করছে। প্রচার পেতে করিমের গানও তারা ব্যবহার করেছে। কপিরাইট 
    আইন মোতাবেক তার পরিবার সুর ও গীতের জন্য রয়ালটি পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু তারা আজ নির্বিকার। অথচ এখন তারা কৌশলে পৌঁছে গেছে করিমের কবর পর্যন্ত। সম্ভবত এ কারণেই জীবিতকালে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, মরার পর আমার হাড়-হাড্ডি নিয়েও ব্যবসা হবে।


    সিলেট শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আ. হান্নান ছিলেন আবদুল করিমের ভক্ত। তিনি তার লেখা গানের খাতা পৌঁছে দেন বাংলা একাডেমির পরিচালক শামসুজ্জামান খান-এর কাছে। মূলত তিনিই বাউল আবদুল করিমকে আবিষ্কার করে তুলে আনেন বর্তমানের এই বৃহৎ পরিমণ্ডলে।  
    আবদুল করিম অসংখ্য গান লিখেছেন। এর মধ্যে প্রায় সাতশ’ গান সংগ্রহে রয়েছে। বিভিন্ন শিল্পী মূল সুরের বিকৃতি ঘটিয়ে তার গান গাইছেন। শুধু তাই নয়, এই আক্রমণ থেকে গানের মূল গীতও রেহাই পাচ্ছে না। জীবদ্দশাতেই তিনি এসব দেখে মনের দুঃখে বলেছিলেন, আমি যেহেতু গানের স্বরলিপি করে যেতে পারলাম না, তাই সুরের খানিকটা এদিক সেদিক হলে আপত্তি নেই, তবে গীত (কথা) যেন ঠিক রাখা হয় । 
    কথাপ্রসঙ্গে শাহ্ নূর জালালের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানলাম। এক পর্যায়ে এও জানলাম যে,  বাংলাদেশ এবং ভারতের একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বাউল শাহ আবদুল করিম এবং তার গান নিয়ে গবেষণা করছেন। বর্তমানে  ধলগ্রামে বছরে দুইবার লোক উৎসব হয়। একবার ১২ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু দিবসে, আরেকটি সরলা খাতুনের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বাংলা পৌষ মাসের প্রথম শুক্রবার। এসব অনুষ্ঠানে দেশের অনেক জায়গা থেকে অগণিত ভক্ত সমবেত হন। 

    No comments:

    Post a Comment

    Fashion

    Beauty

    Travel