বুলবুল আহম্মেদ জয়,
বাড়ি থেকে ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন বগুড়ার শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার।
ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতেই পরকীয়া প্রেমের অভিযোগ তুলে মা-মেয়েকে মারধর ও মাথা ন্যাড়া করে দেওয়াহয়।
তার সবেচেয় বড় ‘অপরাধ’, সে ছিল নারী। তাকে ‘ভোগ’ করা যায়, ধর্ষণ করা যায়। হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। তার আরেকটি ‘অপরাধ’ সে ছিল গরিব।
আপাতচক্ষে ধর্ষণকে বিকৃতকামী মানসিকতা বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এই বিকৃতকামুকতা সমাজের এক গভীর অসুখ। তেমন কোনও সামাজিক প্রতিবাদ হবে না। পুরুষতান্ত্রিক কামবোধের সঙ্গে ধর্মীয় বিভেদমূলক মানসিকতা মিলে চূড়ান্ত অরাজকতা! এই অরাজকতাই দিন দিন পোক্ত হচ্ছে। আর সরকার ‘মধ্য আয়ের দেশে’ পরিণত করার মুলা ঝুলিয়ে যাবতীয় অনাচারের ব্যাপারে চোখ বন্ধ রেখে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিচ্ছে!
দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়াতে অপরাধীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। তারা যা খুশি তাই করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কিংবা সামাজিক প্রতিরোধ কোনওটাই জোরদার হচ্ছে না। ফলে দেশটা ক্রমেই অপরাধীরদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ যদি নিরাপদে থাকতে না-ই পারে তাহলে আমাদের এই পোশাকি গণতন্ত্র আর উন্নয়ন দিয়ে কী হবে? তাতে সমাজটাই সমাজবিরোধীদের মুক্ত রাজ্য হয়ে ওঠে৷ এক সময় এমন হয়, শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না৷ আমাদের সমাজও যদি অপরাধীদের দখলে চলে যায়, মানুষ দাঁড়াবে কোথায়?
যৌন হয়রানি, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করার কোনও সুযোগ নেই। ধর্ষণের ফলে শুধু একটি নারীই ধর্ষিত হয় না, ধর্ষিত হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজ। কারণ, নারীর অসম্মান, মানবতার অসম্মান, পুরো সভ্যতার জন্যই মানহানিকার। খুনের ক্ষমা আছে, ধর্ষণের নেই৷ অপরাধ স্বীকার করলে খুনিকে ক্ষমা করা যেতে পারে৷ তার সংশোধনের সুযোগও গ্রাহ্য৷ ধর্ষণকারীর বেলায় সেটা খাটে না৷ কঠোরতম শাস্তি তাকে পেতে হবে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন এ কথাই ঘোষণা করেছে৷
পুরুষতান্ত্রিক বিধানে যৌনতার অনুষঙ্গকে বহন করে চলার আবহমানকালীন অভ্যাস মেয়েদের মেনে নিতে হয়েছে বলে নিজস্ব এক সন্ত্রাসের জগতে বাঁচাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অনিবার্য নিয়তি। সে জগতে অবিশ্বাস-ধস্ত নারী, পুরুষের প্রতিপক্ষে একা নারী। নারীর মন সেখানে অস্বীকৃত-উপেক্ষিত, কেবল আছে তার শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে আদিমতার উল্লাস। ভোগের সেই উৎসবে শামিল শত-সহস্র-লক্ষ জন। নইলে ব্যক্তিগত শরীর-লালসা থেকে পারিবারিক বিবাদের আক্রোশ পর্যন্ত যে-কোনও কারণেরই সহজ শিকার নারী, প্রতিশোধস্পৃহার সহজ নিবৃত্তি যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ হবে কেন! এই হিংস্রতার অনালোচিত বৃত্তে ধরা দিতে হয় কখনও উচ্চশিক্ষিত সপ্রতিভ নারীরকে, লোকাল বাসের যাত্রী নিরীহ গৃহবধূকে, হতদরিদ্র দর্জিবালিকাকে। আবার কখনও আট-নয় বছরের স্কুল ছাত্রীকে, মূক-বধির তরুণীকে, এমনকী দুই-তিন বছরের শিশুকন্যাকেও, কারও নিস্তার নেই।
শুরুর যেমন অন্য এক শুরু থাকে, সব শেষের থাকে অন্য কোনও শেষ। ধর্ষণের পরেও থাকে আর এক রকম ধর্ষণ। তাই পুরুষের সঙ্গে সমান আগ্রহে যে নারীরাও ধর্ষিতার পেশা, জীবনযাত্রা, বিবাহজনিত সুলুকসন্ধান করেন এবং শেষ পর্যন্ত নারীটিকে অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে মহাস্বস্তির কাঙ্ক্ষিত শ্বাস ফেলেন! তাঁরা যে আসলে পুরুষতন্ত্রেরই মুখ, পিতৃশাসনেরই স্বর, এ কথা বুঝি নিজেরাও বোঝেন না। মনে পড়ে যায় ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ অথবা ‘দহন’-এর যন্ত্রণাময় দৃশ্যগুলো। একবার ধর্ষণের পর প্রতিদিনের ধর্ষণ কী ভাবে মেয়েদের জীবন তছনছ করে দেয়, কত সহজে বেদনার দীর্ণতায় ভরে দিতে পারে মেয়েদের অস্তিত্বকে। চূড়ান্ত অবমাননা ও রুদ্ধশ্বাস ক্লেশ বিচিত্র কৌশলে যেখানে নারীকে সইতে বাধ্য করা হয়, সেখানে শোষণ আর যৌনতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাই গ্রামীণ মোড়লের নির্দেশে নারীকে বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরানো যায়, ডাইনি সন্দেহে হত্যাও করা যায়। দিনের আলোয়ও যখন পুরুষ সহকর্মীর কামনার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনও বিকল্প থাকে না, তখন দু’মুঠোয় শূন্যতাকেই কেবল আঁকড়ে ধরতে হয় নারীদের!
নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ করে পুরুষরা। কাজেই এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষদেরই।সংশোধিত হতে হবে আগে তাদেরকেই। মানুষ হতে হলে ‘মনুষ্যত্ব’কেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে, লাম্পট্যকে নয়। এটা মানবতার দায়।
আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। আমরা নিজেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছি। কিন্তু এর জন্য কখনও অনুশোচনা প্রকাশ করি না। আত্মজিজ্ঞাসাও আমাদের মনে জাগে না। অনেক সময় কোনও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে আমরা প্রতিবাদী হই; কিন্তু এই প্রতিবাদের মুহূর্তে নিজেদের দিকে তাকাতে ভুলে যাই। ভুলে যাই আমরা পুরুষ হিসেবে, অনেক সময়ই সচেতন বা অবচেতনে পুরুষতন্ত্রের অংশ হয়েছি। প্রত্যক্ষ নির্যাতনে শামিল না হলেও গোপন নির্যাতনে মদত দিয়েছি। এই মুহূর্তটি তাই নিজেদের সংশোধনের মুহূর্ত। তার চেষ্টা শুরু করার মুহূর্ত। কী ভাবে নিজেদের বদলাতে পারি আমরা, পুরুষেরা?
আর তা না হলে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করি: আসুন পুরুষ, আমরা ধর্ষণ করি, ধর্ষক হিসেবে নিজেদের পরিচয় গড়ি!!
No comments:
Post a Comment